কক্সবাজার, বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪

নদী শুকিয়ে যায়, দখলদারদের ‘গলা’ শুকায় না

প্রথম আলো জানাচ্ছে, ২৩ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) লাউতলা খালের জায়গা উদ্ধারে অভিযানে গেলে ফারজানা হোসেনসহ বেশ কয়েকজন মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী তাঁদের ‘বরাদ্দ’ জায়গায় গড়ে তোলা কাঁচাবাজার উচ্ছেদের প্রতিবাদ জানান। সে সময় বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকেন তাঁরা।

এ ঘটনার পটভূমিতে ‘চোরের মায়ের বড় গলা’ প্রবাদটি কিঞ্চিৎ ক্লিশে ঠেকারই কথা অনেকের কাছে। কেননা, চুরির বিষয়টি সাধারণত রাতের অন্ধকারে বা আড়ালে ঘটে। এ ক্ষেত্রে ঘটেছে দিনদুপুরে জনগণের সম্পত্তির অবৈধ দখল এবং সেই দখল কায়েম রাখতে রীতিমতো ‘ক্ষমতা’র প্রদর্শন, হম্বিতম্বির ঘটনা।

খালটি বুজিয়ে ট্রাক টার্মিনাল ও ট্রাকচালক ইউনিয়ন গড়ে তোলা ব্যক্তিরা আরও একধাপ এগিয়ে। তাঁরা পুলিশ, প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়েন। কী বলা যায় একে, ‘অবৈধ দখলদারদের লম্বা হাত’! কিন্তু আইনের শাসনের দেশে আইনের হাতটিই তো কেবল ‘লম্বা’ থাকার কথা। অবশ্য পরপর তিন দিন সংবাদপত্রের পাতায় চোখ বুলালে বা সংবাদভিত্তিক টেলিভিশনের পর্দায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে যে কারও উপলব্ধি হতে বাধ্য, এসবই এখন কথার কথা!

কিন্তু এটা কথার কথা না-ও হতে পারে যে রাজধানীর যে রাস্তায় আপনি পা ফেলছেন অথবা যে ভবনে বাস করেন কিংবা যে বিপণিবিতানে কেনাকাটা করেন, সেটি গড়ে উঠেছে কোনো খাল, জলাশয় বা পুকুর বুজিয়ে। কেবল রাজধানী নয়, সারা দেশে বহু নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুর-জলাশয় ভোজবাজির মতো হাওয়া হয়ে গেছে। সুরম্য ভবন, আজদাহা কলকারখানা, গমগমে হাটবাজার দেখে বোঝার উপায় নেই, সেখানে একসময় খাল-বিল বা বনভূমি ছিল। ছোট টংঘর থেকে শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ডকইয়ার্ড থেকে বালুমহাল—কী গড়ে তোলেননি দখলদারদের তালিকায় থাকা গণমান্য ব্যক্তি থেকে রাজনীতিবিদ, আইনপ্রণেতা থেকে শুরু করে আইনের প্রতি ‘শ্রদ্ধাশীল’ সব শ্রেণি-পেশার সাধারণ নাগরিক; অর্থাৎ দখল আর কোনো রাখঢাকের বিষয় নয়, তা হরিলুটে পরিণত।

গত বছর সরকারি নদ-নদী দখলদারদের প্রাথমিক তালিকায় ৪২ হাজার ৪২৩ জনের নাম উঠে এসেছে। আর ২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সংসদকে জানান, দেশের ৬৪ জেলায় চিহ্নিত অবৈধ নদ-নদী দখলদারের সংখ্যা ৪৯ হাজার ১৬২।

অন্যদিকে গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বন বিভাগের দেওয়া তথ্য বলছে, সারা দেশে ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৫৮ একর বনের জমি জবরদখল করে রেখেছেন ১ লাখ ৬০ হাজার ৫৬৬ ব্যক্তি। দখলকৃত জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে ঘরবাড়ি থেকে শিল্পকারখানা, কটেজ, ফার্ম, রিসোর্ট ও বাগান। নির্বিঘ্নে চলছে কৃষিকাজ, পশুপালন। দখলের থাবা থেকে রক্ষা পায়নি সংরক্ষিত বনভূমিও। ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ দশমিক শূন্য ৬ একর সংরক্ষিত বনভূমিতে দিব্যি ‘মালিকানা’ স্থাপন করে বসে আছেন ৮৮ হাজার ২১৫ জন।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে, আওয়ামী লীগের প্রয়াত এক সাংসদের বিরুদ্ধে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের মোট ৫৪ একর জায়গা দখল করে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) জানায়, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে পানগাঁও পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার দুই তীরের প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশের ১৭৫ জন দখলদারের মধ্যে দুজন সাংসদ রয়েছেন। তাঁদের একজন আওয়ামী লীগের, অন্যজন জাতীয় পার্টির।

দখলদারদের এ তালিকায় ফারজানা হোসেনদের নাম আছে কি না, জানা নেই। তবে তাঁরা যে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন, তা নিয়ে সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। কেননা, গত বছরের গত ১ জুলাই প্রকাশিত এক রায়ে নদী দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছেন উচ্চ আদালত। বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩, দণ্ডবিধি ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনেও শাস্তির বিধান আছে। সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও, এ পর্যন্ত একজন ‘নদীখোর’কে এক দিনও কারাগারে রাত কাটাতে হয়েছে, এমন কথা জানা যায় না। এতে কি দখলদারেরা আশকারা পান না?

কীভাবে নদ-নদী ‘জীবন্ত সত্তা’, তা হাইকোর্ট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। মানুষ বা অন্য প্রাণী যেভাবে আইনি অধিকার পায়, তেমনই অধিকার পাওয়ার হকদার নদ-নদীও। প্রতিবেশী ভারত, কলম্বিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশে এমন স্বীকৃতির সিলমোহর অবশ্য আগেই পড়েছে।

নদী হত্যার মানে তাই কেবল এর জলধারা বন্ধ করা নয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারাপ্রবাহও রুদ্ধ করা। কবে হুঁশ ফিরবে আমাদের?

পাঠকের মতামত: